সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল
তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠ্ চে, তার কিছুই ভালো লাগ্ চে না
বদ্দি বড়ি নিয়ে এল
মধু দিয়ে মেড়ে বল্ লে, "খাও।"
সে ঠেলে ফেলে দিলে
রাজার কানে খবর গেল
রাজা তাড়াতাড়ি সভা ছেড়ে এল
পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলে
"তোমার কী হয়েছে, কী চাই?"
সে গুম্ রে উঠে বল্ লে,
"তোমরা সবাই যাও
একবার আমার স্যাঙাৎনিকে ডেকে দাও।"
স্যাঙাৎনি এল
রানী তার হাত ধরে বল্ লে
"সই, বস। কথা আছে।"
স্যাঙাৎনি বল্ লে, "প্রকাশ করে বল।"
সুয়োরাণী বল্ লে, "আমার সাতমহলা বাড়ির একধারে তিনটে মহল ছিল দুয়োরাণীর
তারপরে হল দুটো, তারপরে হল একটা
তারপরে রাজবাড়ী থেকে সে বের হয়ে গেল
তার পরে দুয়োরাণীর কথা আমার মনেই রইল না
তারপরে একদিন দোলযাত্রা
নাটমন্দিরে যাচ্চি ময়ূরপংখী চড়ে
আগে লোক, পিছে লশকর
ডাইনে বাজে বাঁশি, বাঁয়ে বাজে মৃদঙ্গ
এমন সময় পথের পাশে
নদীর ধারে ঘাটের উপরটিতে দেখি
একখানি কুঁড়ে ঘর, চাঁপা গাছের ছায়ায়
বেড়া বেয়ে অপরাজিতার ফুল ফুটেচে
দুয়োরের সাম্ নে চালের গুড়ো দিয়ে শঙ্খচক্রের আলপনা
আমার ছত্রধারিণীকে শুধোলেম, "আহা, ঘরখানি কার?"
সে বল্ লে, দুয়োরাণীর।
তারপরে ঘরে ফিরে এসে সন্ধ্যের সময় বসে আছি
ঘরে প্রদীপ জ্বালিনি, মুখে কথা নেই
রাজা এসে বললে, "তোমার কি হয়েচে, কি চাই?"
আমি বল্ লেম্, "এ ঘরে আমি থাক্ ব না।"
রাজা বল্ লে, "আমি তোমার কোঠাবাড়ি বানিয়ে দেব
গজদন্তের দেওয়াল দিয়ে
শঙ্খের গুঁড়োয় মেঝেটি হবে দুধের ফেনার মতো সাদা
মুক্তোর ঝিনুক দিয়ে তার কিনারে এঁকে দেব পদ্মের মালা।"
আমি বললেম, "আমার বড়ো সাধ গিয়েচে
কুঁড়ে ঘর বানিয়ে থাকি তোমার বাহির বাগানের একটি ধারে।"
রাজা বললে, "আচ্ছা বেশ, তার আর ভাবনা কী?"
কুঁড়ে ঘর বানিয়ে দিলে
সে ঘর যেন তুলে-আনা বনফুল
যেম্ নি তৈরি হল অম্ নি যেন মুষড়ে গেল
বাস করতে গেলেম, কেবল লজ্জা পেলেম
তারপরে একদিন স্নানযাত্রা।
নদীতে নাইতে গেছি
সঙ্গে একশো সাতজন সঙ্গিনী
জলের মধ্যে পাল্ কী নামিয়ে দিলে, স্নান হল
পথে ফিরে আসছি, পাল্ কীর দরজা একটু ফাঁক করে দেখি
ও কোন্ ঘরের বউ গা!
যেন নির্ম্মাল্যের ফুল
হাতে সাদা শাঁখা, পরনে লালপেড়ে শাড়ি
স্নানের পর ঘড়ায় করে জল তুলে আনছে
সকালের আলো তার ভিজে চুলে
আর ভিজে ঘড়ার উপর ঝিকিয়ে উঠছে
ছত্রধারিণীকে শুধোলেম, "মেয়েটি কে, কোন্ দেবমন্দিরে তপস্যা করে?"
ছত্রধারিণী হেসে বললে, "চিনতে পারলে না? ঐ ত দুয়োরানী।"
তারপরে ঘরে ফিরে একলা বসে আছি
মুখে কথা নেই
রাজা এসে বল্ লে, "তোমার কী হয়েছে, কী চাই?'
আমি বল্ লেম, "আমার বড় সাধ
রোজ সকালে নদীতে নেয়ে মাটির ঘড়ায়
জল তুলে আনবো বকুলতলার রাস্তা দিয়ে।"
রাজা বল্ লে, "আচ্ছা বেশ, তার আর ভাবনা কি?"
রাস্তায় রাস্তায় পাহারা বস্ ল, লোকজন গেল সরে
সাদা শাঁখা পরলেম, আর লালপেড়ে শাড়ি
নদীতে স্নান সেরে ঘড়ায় করে জল তুলে আনলেম
দুয়োরের কাছে এসে মনের দুঃখে ঘড়া আছড়ে ভাঙলেম
যা ভেবেছিলেম তা হল না, শুধু লজ্জা পেলেম
তারপরে সেদিন রাসযাত্রা
মধুবনে জ্যোৎস্নারাতে তাঁবু পড়ল
সমস্ত রাত নাচ হল গান হল
পরদিন সকালে হাতির উপর হাওদা চড়ল
পর্দার আড়ালে বসে ঘরে ফিরছি
এমন সময় দেখি বনের পথ দিয়ে কে চলেচে
তার নবীন বয়েস
চূড়ায় তার বনফুলের মালা
হাতে তার ডালি; তাতে শালুক ফুল
তাতে বনের ফল, তাতে ক্ষেতের শাক
ছত্রধারিণীকে শুধোলেম, "কোন্ ভাগ্যবতীর ছেলে পথ আলো করেছে?"
ছত্রধারিণী বল্ লে, "জান না? ঐ ত দুয়োরানীর ছেলে
ওর মা'র জন্যে নিয়ে চলেচে, শালুক ফুল, বনের ফল, ক্ষেতের শাক।"
তারপরে ঘরে ফিরে একলা বসে আছি
মুখে কথা নেই
রাজা এসে বল্ লে, "তোমার কী হয়েচে, কি চাই?"
আমি বল্ লেম, "আমার বড় সাধ
রোজ খাব শালুক ফুল, বনের ফল, ক্ষেতের শাক
আমার ছেলে নিজের হাতে তুলে আনবে।"
রাজা বললে, "আচ্ছা বেশ, তার আর ভাবনা কি?"
সোনার পালঙ্কে বসে আছি, ছেলে ডালি নিয়ে এল
তার সর্ব্বাঙ্গে ঘাম, তার মুখে রাগ
ডালি পড়ে রইল, লজ্জা পেলেম
তার পরে আমার কি হল কি জানি
একলা বসে থাকি, মুখে কথা নেই
রাজা রোজ এসে আমাকে শুধোয়, "তোমার কী হয়েছে, কি চাই?"
সুয়োরানী হয়েও কি চাই
সে কথা লজ্জায় কাউকে বলতে পারি নে
তাই তোমাকে ডেকেচি স্যাঙাৎনি
আমার শেষ কথাটি বলি তোমার কানে, "ঐ দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই।"
স্যাঙাৎনি গালে হাত দিয়ে বল্ লে, "কেন বল ত?"
সুয়োরানী বল্ লে, "ওর ঐ বাঁশের বাঁশীতে সুর বাজ্ ল
কিন্তু আমার সোনার বাঁশী কেবল বয়েই বেড়ালেম
আগলে বেড়ালেম, বাজাতে পারলেম না।"
Поcмотреть все песни артиста